আগের পর্বে ছিল হারিয়ে যাওয়া গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার মধ্যে ডাংগুলি, লাঠি খেলা, লাটিম, মার্বেল ইত্যাদি খেলাগুলো নিয়ে আলোচনা। চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক হারিয়ে যাওয়া আরো কয়েকটি খেলা সম্পর্কে ।

লুডু খেলা

লুডু একটি ঘরোয়া খেলা। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে এ খেলার প্রচলন ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু এখন মোবাইল ফোনে এ খেলার অ্যাপসের কারণে আসল লুডু বোর্ডের পরিবর্তে মানুষকে ভার্চুয়ালিই লুডু খেলতে দেখা যায়।

ল্যাটিন শব্দ লদো থেকে উৎপত্তি হয়েছে লুডুর। লদো মানে আই প্লে বা আমি খেলি। তবে ভারতীয়দের মতে হিন্দি পাচিসি আবার বাংলা পাশা থেকেও লুডুর উৎপত্তি হয়েছে বলে জানা যায়।

লুডু খেলার জন্য প্রয়োজন ২,৩ অথবা ৪ জন প্রতিযোগী। এছাড়া থাকে চারটি ঘরে বিভক্ত একটি বোর্ড ও ছক্কার ডাইস । সেইসাথে সবুজ, হলুদ, লাল, নীল ইত্যাদি রঙের প্রতিটিতে চারটি করে ১৬ টি গুটি । লুডু খেলায় কমপক্ষে ২ খেলোয়াড় প্রয়োজন হয়। তবে কেউ চাইলে একাকীভাবে সাপ লুডু খেলতে পারে। তাছাড়া ২, ৩ ও ৪ জনে মিলে লুডু খেলায় অংশ নিয়ে থাকে।

লুডু খেলাকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়- ঘর লুডু, সাপ লুডু ও পৃথিবী ভ্ৰমণ লুডু।
প্রতিটি খেলোয়াড়ের থাকে ভিন্ন রঙের ৪ টি করে গুটি। আর ৪ জন খেলোয়াড় আলাদা আলাদা ঘরে নিজেদের গুটি রেখে খেলে থাকে।

চারটি ঘর বলতে লুডু বোর্ডের ৪ টি স্টপকেও বোঝায়। গুটি চালু করতে বা খেলা শুরু করতে খেলোয়াড়দেরকে অবশ্যই ছক্কা ফেলতে হয়। ছক্কা ফেলা মাত্রই খেলোয়াড় তার নিজের গুটি বের করে খেলা শুরু করতে পারে। তবে কেউ পরপর ৩ বার ছক্কা ফেললে তার দান বাতিল হয়। তাকে পুনরায় চাল দিতে হয়। তাছাড়া ডাইস গড়ানোর পর যদি সেই ডাইস লুডু বোর্ড থেকে বাইরে এসে পড়ে তাহলেও প্রতিযোগীর ঐ দান বাতিল হয়ে যায়।

ছক্কার ডাইস বোর্ডের ওপর গড়িয়ে ফেলে ডাইস থাকা নির্দিষ্ট যে সংখ্যক ফোঁটা উপরের দিকে উঠে এবং সেই সংখ্যা অনুযায়ী গুটি সামনের দিকে এগুতে থাকে। এভাবে যে খেলোয়াড় বোর্ডের পুরো ছক একবার পার করে সবার আগে ফিনিশিং লাইনে তার ৪ টি গুটি তুলেতে পারে তিনিই বিজয়ী।
চারজন খেলোয়াড় আলাদাভাবে খেলার পাশাপাশি বিপরীত দিকের ঘরের দুইজন প্রতিযোগী জুটি বেঁধেও খেলতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে জুটি বাঁধা দুইজন খেলোয়াড়কে আলাদা ভাবে প্রথমগুটি বের করে খেলা শুরু করতে হয়। অর্থাৎ, প্রত্যেককে আলাদাভাবে ছক্কা ফেলতে হয়। তারপরে একে অন্যের দান ব্যবহার করার সুযোগ পান। এছাড়া জুঁটির দুজনের মধ্যে একজনের চারটি গুটি ফিনিশিং লাইন নিলে অন্য খেলোয়াড় তাঁর দান ব্যবহার করতে পারেন ।

নিয়ম অনুযায়ী সর্বনিম্ন দুটি গুটি থাকলে তখনই একজন খেলোয়াড় অন্যের গুটি কাটতে পারবেন। এছাড়া ব্লক থেকে গুটি বের করার পর ইচ্ছে করলে যেকোন সময় নিজের দুটো গুটি একসাথে ডাবল করে চালান যায়। তবে ডাইসে জোড়া ফোঁটা যেমন ২,৪ বা ৬ উঠলেই কেবল ডাবল বা জোড়া গুটি একসাথে চালানো যাবে।

এক্কা-দোক্কা খেলা

এক্কা-দোক্কা খেলাটি বাংলাদেশের অনেক জায়গায় কুতকুত, সাতখোলা, চিড়িয়া ইত্যাদি নামেও পরিচিত । খেলাটির উপকরণ হল ভাঙা হাঁড়ি বা কলসির গোলাকার টুকরা যা গ্রামে ’চাড়া’ নামে পরিচিত। সাধারণত মেয়েরাই এ খেলায় অংশ নিয়ে থাকে।

ঘরের ছাদ, বাড়ির উঠান বা খোলা জায়গায় মাটির ওপর দাগ কেটে একটি আয়তাকার ঘর করা হয়। ঘরের ভেতরে আড়াআড়িভাবে সরল রেখা টেনে করা হয় ছয়টি খোপ । ছয়টি ঘরের নাম যথাক্রমে এক্কা, দোক্কা, তেক্কা, চৌক্কা, পক্কা ও লাষ্ঠি। চার ও ছয় নম্বর খোপ খাড়া রেখা দ্বারা দুভাগ করা হয়। চার নম্বব ঘরটি হচ্ছে বিশ্রামঘর।

চাইলে খেলাটি একা খেলা যায় আবার দুজন অথবা দুজনের বেশি প্রতিযোগী নিয়েও খেলা যায়।

একজন চাড়াটি প্রথম ঘরে ফেলে এক পায়ে ভর করে লাফিয়ে পায়ের আঙুলের টোকা দিয়ে ‘কুত কুত’ বলতে বলতে চাড়া অন্য ঘরে নিয়ে যায়। এভাবে সবগুলো ঘর ঘুরে চাড়াটি দাগের বাইরে নিয়ে আসতে হয়। তারপর চাড়াটি দ্বিতীয় ঘরে ফেলে আবার খেলা শুরু হবে। এমন করে ছয়টি খোপে চাড়া ফেলে সবার আগে যে ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করবে সে জয়ী হবে।

চাড়া আঙুলের টোকা দিয়ে অতিক্রমের সময় যদি কোনো দাগের ওপর থেমে যায়। তবে ওই খেলোয়াড় দান হারাবে।

অঞ্চলভেদে খেলাটির আলাদা রীতি রয়েছে। যেমন চাড়াটি কপালে রেখে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ঘরগুলো অতিক্রম করা, না দেখে ঘরে উল্টোদিক থেকে চাড়া ফেলা ইত্যাদি।

ষোল গুটি খেলা

অনেকের মতে দাবা খেলার গ্রাম্য সংস্করণ হল ষোল গুটি খেলা। এ খেলায় প্রয়োজন হয় দুজন প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রত্যেকে ১৬ টি করে মোট ৩২ টি গুটি নিয়ে খেলা হয় ষোল গুটি। সেক্ষেত্রে উভয়পক্ষের গুটির রঙ আলাদা হয়।

মাটিতে দাগ কেটে ষোল গুটির ঘর বানানো হয়। এ ছক দেখতে অনেকটা যুদ্ধের কৌশলের মতো। ঘরের মাঝখানের একটি দাগ দান চালার জন্য খালি থাকে।একটি গুটির সামনে পেছনে বামে ডানের নিকটতম বিন্দু ফাঁকা থাকলেই শুধুমাত্র চাল দেওয়া যায়। তবে সামনে অপরপক্ষের গুটি থাকলে চাল দেয়া যায় না।

কিন্তু অপরপক্ষের গুটির পেছনের আড়াআড়ি বিন্দুটি ফাঁকা থাকলে ওই বিন্দুতে রাখা যাবে নিজের গুটিটি। মানে অপরপক্ষের গুটি খাওয়া পড়বে। এভাবে অপরপক্ষের গুটি সবগুলো যে খেতে পারবে তিনিই হবেন বিজয়ী।

বুদ্ধি, ধৈর্য, কৌশলের খেলা ষোল গুটি। বর্তমানে কম্পিউটারে এই খেলাটি খেলা যায়।

কানামাছি

বহুল প্রচলিত ‘কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ,’ ছড়ার লাইনটি ছোটবেলায় শোনেনি এমন মানুষ খুবই কম । আর এ লাইনটির সাথে জড়িত কানামাছি খেলা।

কানামাছি খেলায় নিয়মানুযায়ী একজনের চোখ বেঁধে কানা বা অন্ধ সাজানো হয় আর বাকি খেলোয়াড়রা হয় মাছি, যারা মাছির মতো ঘুরতে থাকে চোখ বাঁধা খেরোয়াড়টির চারপাশে।

এ খেলায় আরেকটি মজার ব্যাপার হল চোখ বাঁধার পর ওই খেলোয়াড়ের সামনে আঙুল নাড়িয়ে পরীক্ষা করে নেওয়া হয় চোখ বাঁধা ঠিক হয়েছে কিনা।
চোখ বাঁধা অবস্থায় খেলোয়াড়টি বাকিদের মধ্যে যাকে ছুঁতে পারবে এবং নাম বলতে পারবে পরেরবারের জন্য ধরা পড়া ওই খেলোয়াড়কে চোখ বেঁধে সাজানো হবে কানা।