৭২ হাজার টন সার আত্মসাত করে সরকারের ৫৮২ কোটি টাকা ক্ষতি করার অভিযোগ উঠেছে নরসিংদী-২ আসনের সাবেক এমপি কামরুল আশরাফ খানের (পোটন) বিরুদ্ধে। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) কাছে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
কৃষকের কাছে ন্যায্যমূল্যে ও সঠিক সময়ে সার পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যে ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ৩ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানি করে সরকার। অভিযোগ উঠেছে ওই সারের মধ্যে ৭২ হাজার টন সার আত্মসাত করেছে সাবেক এমপি পোটনের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স। এ ঘটনায় সরকারের প্রায় ৫৮২ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে বিসিআইসির তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
সার আত্মসাতের বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনা হলে অধিকতর অনুসন্ধানের জন্য গত ৫ জানুয়ারি দুদককে নির্দেশ দেন আদালত। হাইকোর্টের আদেশ পাওয়ার পর কমিশন এ অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। গত ২৯ মার্চ দুদকের উপপরিচালক মো. রফিকুজ্জামানকে প্রধান করে ৩ সদস্যের একটি টিম গঠন করা হয়। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমান ও মো. আবুল কালাম আজাদ। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বিসিআইসির কাছে তথ্য-উপাত্ত চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদক। আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে চাহিদাকৃত তথ্য-উপাত্ত দুদকে জমা দিতে বলা হয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে অনুসন্ধান টিমের প্রধান মো. রফিকুজ্জামান বলেন, কমিশনের নির্দেশনায় অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। চিঠিপত্র দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে কিছু বলা যাবে না।
অন্যদিকে যার বিরুদ্ধে অভিযোগে সেই সাবেক এমপি ও পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান (পোটন) বলেন, বিষয়টি হাইকোর্টে বিচারাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করা সঠিক হবে না।
সার আত্মসাতের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে দুদকের দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, পরিবহন ঠিকাদার পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি ২০২১-২২ অর্থ বছরে বিসিআইসি কর্তৃক আমদানিকৃত ৫৮২ কোটি টাকা মূল্যের ইউরিয়া সার খালাসের পর সরকারি গুদামে না পৌঁছে দিয়ে আত্মসাৎ করেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বেশ কিছু রেকর্ডপত্র প্রয়োজন। এসব রেকর্ডপত্র আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে দুদকে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।
যেসব রেকর্ডপত্র চাওয়া হয়েছে
তলবকৃত রেকর্ডপত্রের মধ্যে রয়েছে বিসিআইসির পরিবহন ঠিকাদার মেসার্স পোটন ট্রেডার্স কর্তৃক সার গুদামে না পৌঁছানোর বিষয়ে ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর গঠিত দুটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। সার পরিবহনের জন্য বিসিআইসি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র।
এর আগে দুদক পরিচালক আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে অনুসন্ধানের নির্দেশনার বিষয়টি জানানো হয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ৫৮২ কোটি টাকার সার আত্মসাৎ নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। উক্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে গত ৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত রুল ইস্যু করেন। এ অভিযোগের বিষয়ে আগামী ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান সম্পন্ন করে আদালতে দাখিলের জন্য দুদককে নির্দেশ প্রদান করেন। তাই হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হলো।
অভিযোগ ও বিসিআইসির তদন্ত প্রতিবদন সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আমদানি করা ৩ লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার খালাসের পর সরকারি গুদামে পৌঁছে দিতে পোটন ট্রেডার্সের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী সারগুলো ৫০ দিনের মধ্যে গুদামে পৌঁছে দিতে হবে। সেই অনুযায়ী পৌঁছানোও হয়। কিন্তু হিসাব বলছে খালাস হওয়া সারের মধ্যে ৭২ হাজার টন গুদামে সরবরাহ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্স। যার বাজারমূল্য ৫৮২ কোটি টাকা।
পোটন ট্রেডার্সের গুদামে আমদানি করা সার মজুত আছে কি-না যাচাই করতে ২০২২ সালের ১০ নভেম্বর বিসিআইসি দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই ২ কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোটন ট্রেডার্স গত বছরের অক্টোবরের শুরুতে জানিয়েছিল তাদের ৬টি গুদামে ৬৬ হাজার টন সার রয়েছে। তবে সরেজমিন তদন্তে গিয়ে গুদামে মাত্র ১ হাজার ৩০০ টন সার পাওয়া যায়। ওই সারও ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৫ মে’র মধ্যে ওই সার খালাস হয়েছিল।
সার আত্মসাৎকারী প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান (পোটন) সাবেক সংসদ সদস্য। তিনি সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সভাপতি। তিনিই মূলত দেশে সারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন।
সার সরবরাহ না করার পর মাসের পর মাস পেরিয়ে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি বিসিআইসি। সর্বশেষ গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে বিসিআইসির পক্ষ থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়।
সার মজুত না থাকার বিষয়টি পোটন ট্রেডার্সের মহাব্যবস্থাপক শাহাদাত হোসেন ও মহাব্যবস্থাপক (পরিচালন) নাজমুল হোসেন তদন্ত টিমের কাছে স্বীকার করেন এবং তারা এ বিষয়ক নথিতে সইও করেছেন বলে জানা গেছে।
কালো তালিকায় সাবেক এমপি পোটন
সার আত্মসাতের ঘটনায় কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কোনো দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না পোটনের মালিকানাধীন মেসার্স পোটন ট্রেডার্স। এই প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সরকারিভাবে আমদানি করা সারগুলো বন্দর থেকে খালাসের পর গুদামে পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল পোটন ট্রেডার্সের। পোটনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।
সোমবার (৩ এপ্রিল) সচিবালয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে সারবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক সভা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। সভায় শিল্পমন্ত্রী নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন ও কৃষি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কামরুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।
কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীন কোনো দরপত্রে কামরুল আশরাফ খান পোটন অংশ নিতে পারবেন না। তাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। সার আত্মসাতের কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু তিনি উল্টো মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এটা বাংলাদেশে আরেক সমস্যা। তবে আমরা খুব সচেতন আছি। তিনি অনেক ক্ষতি করেছেন।’
কামরুল আশরাফ খান পোটন ২০১৪ সালে নরসিংদী-২ আসনে জাসদের প্রার্থী জায়েদুল কবিরকে হারিয়ে সংসদ সদস্য হন। জায়েদুল মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করেন। কামরুল আশরাফ খান আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। বর্তমানে এই আসনের সংসদ সদস্য তার ভাই আনোয়ারুল আশরাফ খান, যিনি আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত।