রাজশাহীর আম খুবই সুমিষ্ট। দেশ-বিদেশে এর চাহিদাও ব্যাপক। প্রতি বছরই এখানকার ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদন করা আম ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে রপ্তানি করা হয়। যা থেকে আয় হয় বৈদেশিক মুদ্রা। এবারও ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে কয়েকগুণ বেশি আম উৎপাদন করা হয়েছে। ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদিত আমগুলো বিদেশের বাজারে বিক্রি করা গেলে এ বছর আয় হবে ২০০ কোটি টাকারও বেশি।
জানা গেছে, রাজশাহী জেলায় আম উৎপাদনে শীর্ষে বাঘা উপজেলা। বাঘায় জেলার এক তৃতীয়াংশ আম উৎপাদন হয়ে থাকে। আমগুলো খুব সুমিষ্ট হওয়ায় বিদেশেও এর চাহিদা রয়েছে। গেল বছর এই উপজেলা থেকে ৩৬ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করা হয়েছে সাত থেকে ১০টি দেশে। এই দেশগুলোতে ছয়টি জাতের আম পাঠিয়ে ভালো দাম পেয়েছেন ব্যবসায়ী ও চাষিরা। তাই এ বছরও আম রপ্তানিতে ঝুঁকছেন তারা। এ বছর শুধু বাঘা উপজেলা থেকে ২০০ মেট্রিক টন আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
উপজেলা কৃষি অফিস বলছে, এ বছর বাঘায় প্রায় ৭২০ মেট্রিক টন আম রপ্তানির লক্ষ্যে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে উৎপাদন করছেন চাষিরা। সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে সেগুলো রপ্তানি করা হবে সাতটি দেশে। এ বছর রাজশাহী জেলায় ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদন হয়েছে। তার মধ্যে শুধু বাঘা উপজেলায় ৮ হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে আম উৎপাদন হয়েছে।
তবে শুধু বাঘাতেই নয়, বিদেশে রপ্তানির লক্ষ্যে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি অনুসরণ করে আম উৎপাদন করছেন রাজশাহী নগরীর তেরখাদিয়ার শান্তিবাগ এলাকার আনোয়ারুল হক।
তিনি বলেন, ফ্রুট ব্যাগগুলো চীন থেকে আমদানি করা হয়। ব্যাগ আমে পরানো মিলে খরচ হয় ৫ টাকা করে। এর মধ্যে একজন শ্রমিককে প্রতি ব্যাগে এক টাকা করে দিতে হয়। শ্রমিকরা সব আমে ব্যাগ পরান না। যে আমগুলো আকারে বড় বা দেখতে সুন্দর সেই আমগুলোতে ফ্রুট ব্যাগ পরানো হয়। এই পদ্ধতিতে আম উৎপাদনে খরচ নেই বললেই চলে। এতে করে একবারে বিষমুক্ত আম পাওয়া যায়।
আনোয়ারুল হক বলেন, বাগান থেকে পর্যায়ক্রমে গোপাল ভোগ, ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, ফজলি, আম্রপালি ও বারি-৪ জাতের আম রপ্তানি করা হয়। এসব আম ইংল্যান্ড, সুইডেন, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ডে পাঠানো হয়। এ বছর প্রথম জেদ্দা, ওমান ও সিঙ্গাপুরে আম পাঠাবো। আমি ২০১৬ সাল থেকে বিদেশে আম রপ্তানি করি। প্রথম বছরে ১০ মেট্রিক টন আম পাঠিয়েছি। পরের বছর ২০১৭-১৮ সালে ৭ মেট্রিক টন করে, ২০১৯ সালে ১০ মেট্রিক টন, ২০২০ সালে ৫ মেট্রিক টন, ২০২১ সালে করোনার শেষ পর্যায়ে ১২ মেট্রিক টন ও সর্বশেষ ২০২২ সালে ১৫ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করেছি। এ বছর আশা করছি ৩০ মেট্রিক টন রপ্তানি করব বিদেশে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর রাজশাহীর বাঘা থেকে ২১ দশমিক ২৮ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করা হয়েছে। এসব আম ফিলল্যান্ড, হংকং, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, সুইডেন ও ইতালিতে পাঠানো হয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানি হয়েছে ইংল্যান্ডে। এ বছর আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিধারণ করা হয়েছে ৭২০ মেট্রিক টন। আমগুলোর মধ্যে রয়েছে- ক্ষীরশাপাতি, ল্যাংড়া, আম্রপালি, ফজলি, লক্ষ্মণ ভোগ, তোতাপুরি (স্থানীয় জাত)। এমন আম উৎপাদনে চাষির সংখ্যা ১৬ জন। তারা বিভিন্ন অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে আমগুলো বিদেশে পাঠান।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আমচাষি সাইফুল ইসলাম সানা বলেন, আম উৎপাদন করি। এরপরে ফ্রুট অ্যান্ড ভেজিটেবল এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের মাধ্যমে পাঠাই। গত বছর ৩৬ মেট্রিক টন আম পাঠিয়েছিলাম। এ বছর আরও বেশি আম পাঠাবো। আমাদের বাঘার আম খুবই সুমিষ্ট। তাই বিদেশে চাহিদাও ব্যাপক। প্রতি বছরই বাঘা থেকে বিদেশে আম রপ্তানি করা হয়ে থাকে। এ বছরও রপ্তানি করা হবে।
আমচাষি ও ব্যবসায়ী আবদুস সালাম বলেন, আমাদের দেশে চাহিদার বেশি আম উৎপাদন হয়। অনেক আম এমনিতেই নষ্ট হয়ে যায়। বিদেশে আমের দাম বেশি। বিদেশে আম রপ্তানি করে টাকা উপার্জন করা যেতেই পারে। বিদেশে আম রপ্তানির বিষয়গুলো সহজ করতে সরকারকে উদ্যাগ নিতে হবে। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে সরকারিভাবে। তাহলে অনেকে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতিতে আম উৎপাদন করবে।
ঢাকার মতিঝিলের আম রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আদব ইন্টারন্যাশনালের চিফ এক্সিকিউটিভ ইসমাইল হোসেন সাগর বলেন, ঢাকায় আমাদের মতো অনেক কোম্পানি আছে, যারা বিদেশে আম রপ্তানি করে থাকে। আমরা প্রতি বছরই বিদেশে আম রপ্তানি করে থাকি। গত বছর ২০ টন আম ফ্রান্স ও ইতালিতে রপ্তানি করেছি। ওই সব দেশে আমাদের বাংলাদেশের আমের ব্যাপক চাহিদা। কিন্তু আমরা তেমন দিতে পারি না। ফ্রান্স ও ইতালিতে শুধু বাংলাদেশের মানুষ আম খায় তা কিন্তু নয়। সেখানে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ছাড়াও অন্য দেশের মানুষ আমাদের দেশের আম খেয়ে থাকেন।
রাজশাহী-চাঁপাই এগ্রো ফুড প্রডিউসারের পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, আমরা ফ্রুট ব্যাগিং করা আম বিদেশে পাঠাই। তবে আম বিদেশে যাওয়ার পথে পচন ধরে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই আম রক্ষায় পচন রোধে ন্যাচারাল কোনো পদ্ধতি সরকারের পক্ষ থেকে চাই। কোনো মেডিসিন নয়। রাজশাহী থেকে ঢাকায় আম নিতে কষ্ট হয়। কুরিয়ার খরচ বেশি। এছাড়া ম্যাঙ্গ স্পেশাল ট্রেনে আম নেওয়া হয়। আম তো পচনশীল। সেক্ষেত্রে বিমানে আম পাঠানোর ব্যবস্থা থাকলে সুবিধা হতো।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, রাজশাহী-চাঁপাইয়ের আম খুবই সুমিষ্ট। দেশব্যাপী ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। রাজশাহীর বাঘা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে অনেকেই বিদেশে আম রপ্তানি করে থাকেন। এটি অনেক ভালো উদ্যোগ। বাংলাদেশের আম বিদেশে যাচ্ছে। সেই দেশের মানুষ বাংলাদেশকে চিনছে। একই সঙ্গে আমাদের বিদেশি মুদ্রা অর্জন হচ্ছে আম বিক্রি করে।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সফিউল্লাহ সুলতান বলেন, গত বছর বাঘা উপজেলা থেকে ৩৬ লাখ টাকার আম রপ্তানি করা হয়েছে। যদিও টাকার অংকে কম। কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্যে রপ্তানির কার্যক্রমটা অব্যহত রাখা। এ বছর ২০০ কোটি টাকার আম রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আমরা কৃষকদের ফ্রুট ব্যাগিং করতে উৎসাহ দিচ্ছি। তারা ফ্রুট ব্যাগিং করছেন। এখন পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ আম ফ্রুট ব্যাগিং করা হয়েছে। আরও ৮ লাখ আম ফ্রুট ব্যাগিং করা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাষিদের আম উৎপাদন ও রপ্তানিতে উৎসাহিত করছি। প্রতি বছর এই ধরনের চাষির সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে ৩৫ থেকে ৪০ জন এই পদ্ধতি অনুসরণ করে আম উৎপাদন করছেন। আম রপ্তানিতে যুক্ত বিভিন্ন এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনে আছেন। আমরা তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। একই সঙ্গে বিভিন্ন সুপার শপগুলোতে যোগাযোগ করছি আমগুলো কেনা ও বিদেশে রপ্তানির বিষয়ে। শুধু আম উৎপাদন নয়, মার্কেটে লিংকও তৈরি করা হয়েছে। গত বছর প্রায় ৩৬ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করা হয়েছে। এ বছর ২০০ মেট্রিক টন আম রপ্তানি করা হবে।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, গাছে প্রচুর আম আছে। সঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণে প্রতিটি গাছে প্রচুর আম রয়েছে। বর্তমানে যে আম গাছগুলোতে রয়েছে তা থাকলেও উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, এ বছর বাঘা উপজেলা থেকে বিদেশে আম রপ্তানি করা হবে। গত বছরের চেয়ে এ বছর আম রপ্তানি বাড়বে। রাজশাহীতে এ বছর ১৯ হাজার ৫৭৮ হেক্টর জমিতে প্রায় ৩৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯৮৬টি আম গাছ রয়েছে। গত বছর ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আম বাগান ছিল। এবার বাগান বেড়েছে ১ হাজার ৬৩ হেক্টর জমিতে। এ বছর হেক্টর প্রতি ১৩ দশমিক ২০ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।
বার্তাবাজার/এ.আর