প্রকৃতি, মানুষ, ইতিহাসবোধ এবং সময় তার কবিতাকে এক বৈশ্বিকতা দিয়েছে এটা যারা তার কবিতা পড়েছেন, জানবেন নিশ্চয়ই। তার মানে এই নয় যে স্টালিনের কবিতা আত্মজৈবনিক নয় বরং মিথের জাদুজগৎ, মানুষের অসহায়তা ও সংগ্রাম, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং আফ্রিকা, আমেরিকা, লাতিন-আমেরিকা, ইউরোপ তথা উপমহাদেশের ক্লাসিকস, মহাকাব্য, পুরাণ ও জাদুবাস্তব জগতের রেফারেন্স স্টালিনের আত্মজৈবনিক কবিতাতেই যেভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে তার তুলনা খুঁজতে গেলে বাংলাভাষার বাইরে তাকাতে হবে!
এই বহুমাত্রিক অনন্তপ্রায় গোলকধাঁধা-এর অন্দরে প্রবেশ করতে সাহস লাগে এবং সেই অভিজ্ঞতাকে আত্মজৈবনিক থেকে সর্বজনীন করে তোলা খুবই কঠিন। স্টালিন এ কাজটি করতে পেরেছেন। স্টালিনের কবিতা তার পাঠনিবিড়তা ও ব্যাপ্তির সব চিহ্নগুলোকে লালন করেও, দার্শনিক বোধের সীমাহীন পরিসরে বিচরণ করেও জনপ্রিয়, খুবই জনপ্রিয়। এবং তার কবিতা সহজ, দুর্বোধ্যতার অভিযোগ স্টালিনের কবিতার প্রসঙ্গে ধোপে টিকবে না!
মানুষের পক্ষে বৈশ্বিক হয়ে ওঠাটা সত্যিই সহজ নয়, আর প্রায়শই যা হয়, তিনি যদি একে উত্তরাধিকার মনে না করে অর্জন মনে করেন তাহলে ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান। স্টালিনকে কাছ থেকে যতটুকু দেখার অবকাশ পেলাম তাতে তিনি তার কবিতার মতোই খোলসবিহীন, সহজ এবং তার প্রজ্ঞা থেকে ঠিকরে বেরোনো এমন কোনো আলো নেই যা মানুষটাকেই আড়াল করে দিচ্ছে। পাঠব্যাপকতা ও দার্শনিক চিন্তার সঙ্গে সহজতার আড়ি দেখেই আমরা অভ্যস্ত, স্টালিনের অবশ্য তেমন কোনো খোলস নেই যা ভাঙার জন্য কসরত দরকার, তিনি এতটাই সহজ। মানুষ ও প্রকৃতির কাছে দায়বদ্ধতা তার বিশ্ববীক্ষায় এবং তার কবিতায় অনুরণিত।
এ কারণেই তার কবিতা সহজ ও জনপ্রিয়। পৃথিবীর নানা ভাষায় তার কবিতা অনূদিত হয়েছে। বাংলা কবিতায় তিনি ইতোমধ্যেই এক মাইলস্টোন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকা রেজাউদ্দিন স্টালিন-এর ষাট বছর পূর্তিতে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে অমল কুমার মণ্ডলের সুদক্ষ সম্পাদনায়।
আমার এ নিরীক্ষণের সমর্থন পেয়েছি কবিতীর্থর উল্লিখিত সংখ্যাটি থেকে বিশিষ্ট সাহিত্য আলোচকদের লেখায় যেগুলো রেজাউদ্দিন স্টালিনকে এবং তার কবিতাকে সমগ্রের পরিপ্রেক্ষিতে বুঝতে সহায়ক।
এ সংখ্যায় স্টালিনের বহুপঠিত এবং অনূদিত অনেক কবিতা সংকলিত হয়েছে শুধু নয়, তার একটি সাক্ষাৎকারও বিধৃত হয়েছে যা অনায়াসে তার কবিতার পূর্বপাঠ বিবেচিত হতে পারে। এছাড়া রয়েছে শিবনারায়ণ রায়, তপোধীর ভট্টাচার্য, সেলিনা হোসেন, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, আবুল কাসেম, তরুণ মুখোপাধ্যায়, সুবোধ সরকার প্রমুখের মূল্যায়ন যেগুলো স্টালিন-পাঠের দর্পন বলা যেতে পারে।
শিবনারায়ণ রায় যেমন বলেছেন : ‘এ যুগে যন্ত্রের সঙ্গে হৃদয়ের যে সংঘাত, তাকে শনাক্ত করার ক্ষেত্রে স্টালিনের পারঙ্গমতাকে স্বীকৃতি দিতে হয়’। এখানে শনাক্ত কথাটির ওপর জোর দিতে চাই- ‘দেখা’ থেকে ‘শনাক্ত’ পরিসরে উন্নীত হওয়ার মধ্যে কবির যে সংবেদনশীলতা থাকে তা অধুনা, যে কোনো কারণেই হোক, স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয় না। স্টালিন সম্পর্কে এ কথা বলা যাবে না। তবে কেবল সংবেদনা নয়, এর জন্য পরিশ্রম লাগে। তপোধীর ভট্টাচার্যের লেখাটি থেকে বলি: “খুবই সুলিখিত এই বয়ান বুঝি দান্তের ইনফের্নোর বদলে পুগেরাটারিওর সামনে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয়। আবার ‘Abandon all hope, ye who enter here’ এক বিকল্প হিসাবে নতুন আশায় সঞ্জীবিত করে…।”
এই আশা তার কবিতা থেকে-এ বড় কম প্রাপ্তি নয়। ‘ডায়োজেনিসের লণ্ঠন’ স্টালিনের সাম্প্র্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ, যেখানে কবির এক অমোঘ উচ্চারণ সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন হোসেনউদ্দিন হোসেন :
আমি গাছের পাতা আর বন্যপশুর
দাঁত থেকে বেরিয়ে এসেছি ( জিজ্ঞাসার চিতা)
সৃষ্টি, বিবর্তন, প্রকৃতি, বিশ্বাস ও জ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মজিজ্ঞাসার বেঞ্চমার্ক হতে পারে এই অনুভব। ফলত স্টালিনের কবিতার একজন পাঠক হিসাবে আমি নিজে প্রত্যয়ী হতে পারি।
স্টালিনের ‘বাঘরক্ষা প্রকল্প’ কাব্যগ্রন্থটির একটি দীর্ঘ আলোচনা করেছেন হাংরি আন্দোলনের কবি মলয় রায় চৌধুরী। তিনি স্টালিনের এই পঙ্ক্তি ‘আমি এক সোনামুখী ধানশীষ, পূর্ণপ্রাণ যাবো’-একে আইকনিক বলেছেন এবং এই আইকনিক শব্দটির সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্টালিনকে প্রথমতম কবির মতো সৎ মনে হয়। মলয় বলেছেন-‘স্টালিন কবি সাজেননি, কবি হয়েছেন’- কথাটা প্রণিধানযোগ্য বটে।
আবুল কাসেম ফজলুল হকের কথায় : ‘আশির দশকে অন্য সবার কাব্যশৈলী বিবেচনায় রেজাউদ্দিন স্টালিন শিল্প কৌশলে অনেক বেশি দক্ষ ও মর্মভেদী।’ কবির দশক বিচারের তাৎপর্য কতটা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে কেননা আমি স্টালিনের মধ্যে প্রথম কবি হয়ে ওঠার সব লক্ষণ আছে বলে মনে করি। প্রথম কবি হয়ে ওঠার সাধনাই যে কোনো সৎ কবির সারা জীবনের সাধনা- ডেস্টিনি। স্টালিনের মধ্যে সেই অন্বেষণ ও পরিশ্রম আছে বলেই তাকে বাংলা কবিতার অন্যতম মাইলস্টোন মানব আমি।
এহ বাহ্য, এ কথা আমি সমর্থন প্রত্যাশায় বলছি এমন নয়, একজন পাঠকের, সাধারণ পাঠকের অনুভব এটি, যা সোচ্চারে বলা দরকার বলে মনে করি আমি।