সব বাধা, হতাশা ও বিপর্যয় পায়ে ঠেলে বঙ্গবন্ধুর সৃষ্ট ‘লড়াকু বাংলাদেশ’ কী করে জোর কদমে এগিয়ে চলেছে সমৃদ্ধির সোনালী স্বপ্ন পূরণের দিকে সেই গল্পটি প্রতিদিনই নতুন নতুন রূপে উদ্ভাসিত হচ্ছে। আইএমএফ-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে আশা করা হচ্ছে আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশ চীন ও ভারতকে প্রবৃদ্ধির হারের বিচারে পেছনে ফেলবে। চলতি অর্থবছরে চীনের চেয়ে বেশি এবং ভারতের পরপরই থাকবে তার অবস্থান।
মোদ্দা কথা, বাংলাদেশ এই মুহূর্তে পৃথিবীর অন্যতম গতিময় অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। এই সাফল্যের গল্পের সমকালীন রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে মে মাসের শুরুতে।
বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন অংশীদারিত্বের পঞ্চাশ বছর উদযাপনের অংশ হিসেবে আয়োজিত এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে তিনি যোগ দিয়েছেন। এই বছর জানুয়ারি মাসে বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ ঢাকায় এসেছিলেন অংশীদারিত্বের পঞ্চাশ বছর উদযাপনের সূচনা অনুষ্ঠানে। সেই সময়েই তিনি বলেছিলেন দারিদ্র্য নিরসন ও সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের সাফল্যের গল্পটি আসলেই অনুকরণীয়।
২০১২ সালে পদ্মাসেতু প্রকল্পের ঋণ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের বড় ধরনের টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। নিজের আত্মমর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে অবিচল বাংলাদেশ সেই সময় এই ঋণ প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেয়। এত বড় প্রকল্প নিজেদের অর্থে বাস্তবায়নের এক সাহসী সিদ্ধান্ত নেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
এই প্রকল্পটি এখন বাংলাদেশর আত্ম-উন্নয়নের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পরে অবশ্যই বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। ২০১২ সালের এই ‘দুর্ঘটনা’র পরেও বছরে এক বিলিয়ন ডলারের মতো ঋণ ও অন্যান্য সহায়তার অঙ্গীকার করতে থাকে বিশ্বব্যাংক।
সংকট উত্তরণে বাংলাদেশের সাফল্যের কারণেই আইএমএফ ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আর এই প্রেক্ষাপটে এডিবি, এনডিবি, জাইকা ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বাংলাদেশকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
অচিরেই তা দু’বিলিয়ন ডলারে উঠে যায়। আর চলতি অর্থবছরে তো তা তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশ এক দশকের মধ্যে উচ্চ মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার যে ‘ভিশন’ বা সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য ঠিক করেছে তাতে প্রচুর অবকাঠামো নির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে। আর এই ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের বড় উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
আগামীতে এই সহযোগিতার পরিমাণ আরও বাড়বে। কেননা বাংলাদেশের জনসংখ্যা বিপুল, অভ্যন্তরীণ বাজারও বড়। এই প্রেক্ষাপটেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বব্যাংক সফরের তাৎপর্যকে দেখতে হবে। তা থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কূটনীতির পরিপক্কতার আভাসও মেলে।
১ মে’র অনুষ্ঠানে এসব প্রকল্পের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের পাশাপাশি বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সাথে তার পঞ্চাশ বছরের অংশীদারিত্বের সাফল্য তুলে ধরে নানা আয়োজনের মাধ্যমে। বিশেষ করে এত সীমিত সম্পদ নিয়ে উন্নয়ন অভিযাত্রা শুরু করে মাত্র চার দশকের মাথায় কী করে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশের মর্যাদা অর্জন করলো এবং দারিদ্র্য নিরসনের ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্যের দাবিদার হতে পারলো—সেই গল্পটিই এই অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয়েছে।
সংকট উত্তরণে বাংলাদেশের সাফল্যের কারণেই আইএমএফ ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। আর এই প্রেক্ষাপটে এডিবি, এনডিবি, জাইকা ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরাও বাংলাদেশকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সাহায্য পেতে যে নীতি সংস্কারের প্রয়োজন সেই কথা বাংলাদেশ জানে এবং মানে। সেই জন্যই বিদেশি সাহায্য, তাই বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেকটাই স্থিতিশীল ও বাড়ন্ত। নানা চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্জন নিঃসন্দেহে চোখে পড়ার মতো।
ইউক্রেন যুদ্ধে সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়া এবং জ্বালানির তেল, ভোজ্যতেল ও সারের দাম বাড়ার কারণে বিশ্ব ও স্থানীয় পর্যায়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ন্ত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার কৃষি, প্রবাসী আয় এবং রপ্তানীমুখী শিল্পকে চাঙা রেখে যেভাবে সারা দেশে কর্মসংস্থানধর্মী ছোট, মাঝারি ও বড় উদ্যোগগুলো সচল রেখেছে তা সত্যি দেখার মতো। এর প্রভাব গিয়ে দারিদ্র্য নিরসনের ওপর নিশ্চয় পড়েছে।
এরই মধ্যে পদ্মাসেতুসহ স্থানীয় ও আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি-সহায়ক অসংখ্য অবকাঠামো সম্পন্ন হয়েছে। ডিজিটাল অর্থায়নের উদ্ভাবনীমূলক অবকাঠামোরও প্রসার ঘটেছে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বলা যায় বিপ্লবই ঘটে গেছে।
মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক লেনদেন ব্যবস্থার সুযোগ হাওর, চর ও পার্বত্য এলাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। একমাত্র মোবাইল আর্থিক সেবার অধীনেই এখন প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে।
এর সাথে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উদ্যোগে কৃষি, এমএসএমই এবং সরকারের বহুমুখী সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অধীনে যে হারে অর্থ শহর থেকে গ্রামে যাচ্ছে তার প্রভাব তো দারিদ্র্য নিরসনে পড়বেই। তাই ২০০৬ সালে দারিদ্র্যের যে হার ৪১ শতাংশ ছিল তা ২০২২ সালে ১৮.৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অতি দারিদ্র্যের হারও ২৫ শতাংশ থেকে কমে ৫.৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
এমনি এক বাস্তবতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংক সফর করলেন তার নেতৃত্বের সংবেদনশীলতা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের অসামান্য গল্প বলার জন্য। অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে তার মাটি ঘেঁষা জনবান্ধব নেতৃত্বের গুণেই বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার দেড় দশকেই অর্ধেকেরও নিচে নামানো সম্ভব হয়েছে।
পাশাপাশি কোভিড ও ইউক্রেন সংকট সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধির হার ছয় শতাংশের বেশি রাখা গেছে। লেগে থাকা এবং সুদূরপ্রসারী এই নেতৃত্বের কারণেই বাংলাদেশের পরিশ্রমী মানুষ ও উদ্যোক্তারা তাদের অসীম সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের নতুন নতুন উপাখ্যান তৈরি করে চলেছেন।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বলা যায় বিপ্লবই ঘটে গেছে। মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিংসহ প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক লেনদেন ব্যবস্থার সুযোগ হাওর, চর ও পার্বত্য এলাকাসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ শুধু নেয় না, তার নেতৃত্বের ও উদ্যোক্তাদের উদ্যম, উদ্ভাবন এবং সাহসের পরাকাষ্ঠাও যে উপহার হিসেবে সারা বিশ্বকে দিতে পারে সেই বার্তাটিও নিশ্চয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের এই বিশেষ অনুষ্ঠানে দিয়েছেন।
তাই মোটেও অবাক হইনি যখন ১৬ এপ্রিল চ্যানেল আইয়ের এক সংবাদ প্রতিবেদনে বাংলাদেশে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর (যিনি এখন ঐ প্রতিষ্ঠানের ভাইস প্রেসিডেন্ট) মার্সি টেম্বন বলেন যে, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যাকে বিশ্বব্যাংকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায়। ফিনিক্স পাখির মতো ধ্বংসের আগুনের ছাই থেকে পুনর্জন্ম হওয়া ব-দ্বীপটির ঘুরে দাঁড়ানোর অসামান্য গল্প গোটা বিশ্বকে জানাতে চান তিনিও।’
বিশ্বব্যাংক বর্তমান বিশ্বে প্রধান এক আন্তর্জাতিক সহযোগী। চলমান ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন এড়িয়ে কী করে সাধারণ মানুষের কল্যাণে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে তাদের উন্নয়ন অভিযাত্রা অক্ষুণ্ন রাখতে পারে সেই পথকে সুগম করাও বিশ্বব্যাংকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বব্যাংক সফরের মধ্য দিয়ে বিশ্ব শান্তি ও বিশ্ব জনকল্যাণের ক্ষেত্রের পরিসর আরও প্রসারিত করার সুযোগ এনে দেবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ-বিশ্বব্যাংক অংশীদারিত্বের পঞ্চাশ বছর উদযাপনের এই অনুষ্ঠানে যোগদান এবং তাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার রূপরেখা নির্ধারণে তার অভিমত—বাংলাদেশসহ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের সব দেশের উন্নয়নকামী মানুষের কাঙ্ক্ষিত নির্বিরোধ অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অভিযাত্রায় তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখবে বলে প্রত্যাশা করা নিশ্চয় অযৌক্তিক হবে না।
এই অনুষ্ঠানেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের প্রধানকে পদ্মাসেতুর রেপ্লিকা উপহার দেন। কেউ কেউ বলছেন তা যেন এক ‘মধুর প্রতিশোধ’। আমি অবশ্যই মনে করি এই সেতু বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সহযোগীদের মাঝে এক নয়া বন্ধনের স্মারক। এই বন্ধন অটুট থাক।
লেখক : ড. আতিউর রহমান ।। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক